নিজস্ব প্রতিবেদক
গাজীপুরের জয়দেবপুরে থাকাকালীন বেশ কয়েকটি বহুতল ভবনের নকশায় মৌজা ও দাগ নম্বর পরিবর্তনের অভিযোগে বিদ্ধ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)-এর জোন-৩/২ এর অথরাইজড অফিসার প্রকৌশলী শেগুফতা শারমীন আশরাফ। আর্থিক লেনদেন ও অনৈতিক সুবিধা নিয়ে তিনি নকশায় মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকার মৌজার নাম যুক্ত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রাজউক। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শেগুফতা শারমীন আশরাফ। তার দাবি, নকশায় ভুল হলে তার দায় ইমারত পরিদর্শকের।
নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে রাজউকে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব, কর্মপদ্ধতি ও দায় রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
নকশা অনুমোদনের কর্মপদ্ধতি ও কর্মকর্তাদের দায়িত্ব:
প্রথম স্তর (ইমারত পরিদর্শক/প্রধান ইমারত পরিদর্শক): ভবনের নকশা জমা দেওয়ার পর প্রথম ধাপে মাঠ পর্যায়ের ইন্সপেক্টররা সরেজমিনে গিয়ে জমির মালিকানা, দাগ নম্বর, মৌজা এবং প্রস্তাবিত নকশার প্রাথমিক বিষয়গুলো যাচাই করেন। তাদের দায়িত্ব হলো সরেজমিনে তথ্যের সঠিকতা নিশ্চিত করে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন দাখিল করা। এই স্তরে কোনো ভুল হলে পরবর্তী ধাপগুলোতে তার প্রভাব পড়তে পারে। ইমারত পরিদর্শকের দাখিল করা প্রতিবেদনের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে পরবর্তী অনুমোদন প্রক্রিয়া।
দ্বিতীয় স্তর (সহকারী অথরাইজড অফিসার/অথরাইজড অফিসার): প্রথম স্তরে ইমারত পরিদর্শক/প্রধান ইমারত পরিদর্শকের প্রতিবেদনের পর নকশা যায় সহকারী অথরাইজড অফিসার অথবা সরাসরি অথরাইজড অফিসারের কাছে। তাদের প্রধান কাজ হলো দাখিল করা নকশাটি রাজউকের বিল্ডিং কোড ও অন্যান্য নিয়ম-কানুন অনুযায়ী পরীক্ষা করা। ইমারত পরিদর্শকের প্রতিবেদন এবং নকশার বিস্তারিত নিরীক্ষণের পর তারা তাদের মতামতসহ ফাইল ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠান। এই স্তরে জমির মৌজা ও দাগ নম্বরের সঠিকতা পুনরায় যাচাই করার কথা।
তৃতীয় স্তর (বিসি কমিটি/সংশ্লিষ্ট কমিটি): সহকারী অথরাইজড অফিসার বা অথরাইজড অফিসারের সুপারিশের পর ফাইল যায় বিসি কমিটির কাছে। তারা সামগ্রিকভাবে নকশা ও অন্যান্য কাগজপত্র পর্যালোচনা করেন এবং চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করেন। কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বড় প্রকল্পের নকশার ক্ষেত্রে, চূড়ান্ত অনুমোদন দেন স্বয়ং চেয়ারম্যান অথবা রাজউকের গঠিত কোনো বিশেষ কমিটি।
অন্যান্য কর্মকর্তাদের দায়ও উড়িয়ে দেওয়া যায় না:
যদিও অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন অথরাইজড অফিসার শেগুফতা শারমীন আশরাফ, তবে নকশা অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় অন্য স্তরের কর্মকর্তাদের দায়িত্বও কম নয়। ইমারত পরিদর্শকদের মাঠ পর্যায়ের তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই সহকারী অথরাইজড অফিসার এবং বিসি কমিটির সদস্যদেরও প্রতিটি নকশা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা উচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “শুধু একজন অথরাইজড অফিসার নন, বরং প্রতিটি স্তরের কর্মকর্তারই তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা উচিত ছিল। যদি মাঠপর্যায়ের পরিদর্শক ভুল তথ্য দিয়ে থাকেন অথবা বিসি কমিটির সদস্যরা যথাযথভাবে নকশা পর্যালোচনা না করে থাকেন, তবে এর দায়ভার তাদের উপরও বর্তাতে পারে।”
আরেকজন কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, “এতগুলো নকশায় একই ধরনের ভুল ইঙ্গিত দেয় যে সম্ভবত প্রক্রিয়াগত কোনো দুর্বলতা ছিল অথবা একাধিক স্তরের কর্মীর নজর এড়িয়ে গেছে বিষয়টি। কোনো প্রকার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া কেবল একজনের উপর অভিযোগ চাপানো ন্যায়সঙ্গত নয়। তদন্তে সকলের দায়িত্ব এবং গাফিলতি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।”
তবে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম এই বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘শুধু মিরপুর নয়, আরও বেশকিছু জায়গায় নকশা পরিবর্তনের অভিযোগ এসেছে। একই সময়ে এতগুলো ফাইল ভুল হওয়ার কথা নয়। যারা ফাইলগুলোর অনুমোদন দিয়েছেন-তাদের উচিত ছিল সবকিছু আরও যাচাই-বাছাই করে দেখা। কিন্তু তারা তা করেননি। তবে তারা এ ভুলগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে করছেন কি না-তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। এজন্য আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি। সম্পূর্ণ বিষয়টা আমরা তদন্তের আওতায় নিয়ে আসব। তদন্তে যিনি বা যারা অভিযুক্ত হবেন-তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অনুমোদন পাওয়া বিতর্কিত নকশাগুলোতে বিসি কমিটির যে সকল সদস্যদের স্বাক্ষর রয়েছে তারা হলেন- রাজউকের সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) নাসির উদ্দিন (সভাপতি, বিসি কমিটি), প্রধান নগর স্থপতি (চ:দা:) মোস্তাক আহমেদ, জোন-২ এর পরিচালক মোবারক হোসেন (সদস্য, বিসি কমিটি ও সাবেক পরিচালক, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-১) এবং নির্বাহী প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন-৬) রাহাত মুসলেমিন (সদস্য সচিব, বিসি কমিটি, অঞ্চল-ক)। ভবনের নকশা জালিয়াতির বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে রাজউকের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশের চিত্র ইতিপূর্বে গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। উল্লেখিত বিসি কমিটির কতিপয় সদস্যদের বিরুদ্ধেও একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে বিসি কমিটির একজন সদস্যদের বিরুদ্ধে তিনজনকে টপকে বিধিবহির্ভূত পদোন্নতি পাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, বিসি কমিটির দুইজন সদস্য মহাখালী ডিওএইচএস এলাকায় Discreet Architectural Consultant নামক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে ডেভেলপার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে জোন-২ এর পরিচালক মোবারক হোসেন ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকে মামলা চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে।
সচেতন মহলের মতে, প্রকৌশলী শেগুফতা শারমীন আশরাফের যুক্তির পাশাপাশি অন্যান্য কর্মকর্তাদের মন্তব্য এবং নকশা অনুমোদনের বিভিন্ন ধাপ স্পষ্ট করে তোলে যে এখানে কেবল একজনের নয়, বরং সম্মিলিত গাফিলতি থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তদন্তের মাধ্যমেই প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হবে এবং যথাযথ প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা উচিত নয়। তদন্ত কমিটি এখন কোন পথে অগ্রসর হয়, সেটাই দেখার বিষয়।