রাজধানী ঢাকার ভেতরে প্রবেশ ছাড়াই দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে উত্তরাঞ্চলে যাতায়াতের স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। গাজীপুরের ভোগড়া থেকে নারায়ণগঞ্জের মদনপুর পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ জয়দেবপুর-দেবগ্রাম-ভুলতা-মদনপুর সড়ক, যা ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে নামে পরিচিত, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক অনন্য মাইলফলক হয়ে উঠছে। বহুল প্রতীক্ষিত এ সড়ক প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর যানজট কমার পাশাপাশি পণ্য পরিবহন ও আঞ্চলিক অর্থনীতিতে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

জয়দেবপুর-দেবগ্রাম-ভুলতা-মদনপুর সড়ক (ঢাকা-বাইপাস) ফোর লেন প্রকল্পটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে গৃহীত হয়। ২০১৮ সালের ৬ ডিসেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২০২২ সালের ১৫ মে কার্যকর হয়। ২৫ বছরের মেয়াদি এই চুক্তি চলবে ২০৪৭ সালের ১৪ মে পর্যন্ত। নির্মাণকাজের সময়সীমা ধরা হয়েছিল ৩৮ মাস, যা অনুযায়ী ২০২৫ সালের ১৪ জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ, মামলা-মোকদ্দমা ও ইউটিলিটি স্থানান্তরের কারণে কাজ কিছুটা বিলম্বিত হয়। বর্তমানে প্রকল্পের অগ্রগতি প্রায় ৭০ শতাংশ এবং ২০২৬ সালের জুন নাগাদ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার আশা করা হচ্ছে। ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে চার লেনের নিয়ন্ত্রিত প্রবেশ সড়ক হিসেবে নির্মাণ করা হচ্ছে। এর প্রস্থ হবে ২০.২ মিটার। পাশাপাশি থাকবে দুই পাশে সার্ভিস সড়ক, যার প্রস্থ হবে ৪.৮ থেকে ৭.৩ মিটার। সড়কটি একসাথে সংযুক্ত করবে ৪টি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মহাসড়ক—ঢাকা-চট্টগ্রাম (এন১), ঢাকা-সিলেট (এন২), ঢাকা-ময়মনসিংহ (এন৩) এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল (এন৪)। এর ফলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের মধ্যে সরাসরি ও দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

ইতোমধ্যে ভোগড়া থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার মূল সড়ক এবং ভোগড়া থেকে বস্তুল পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটার সার্ভিস সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। ধীরাশ্রম ও মীরেরবাজার এলাকায় দুটি রেলওয়ে ওভারপাস এবং কাঞ্চন, নাগদা ও উলুখোলা এলাকায় আটটি সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। কাঞ্চন থেকে ভুলতা পর্যন্ত মূল সড়কের কাজ চলছে, আর ভুলতা থেকে মদনপুর অংশে চলছে মাটি ভরাট ও অন্যান্য নির্মাণকাজ। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্প সড়কের দশ কিলোমিটার অংশ নির্মাণ সম্পন্ন হলে আংশিক চালুর সুযোগ রয়েছে। তদনুসারে, নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ায় বিগত ২৪ আগস্ট থেকে ভোগড়া থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ১৮ কি.মি. অংশে টোল প্রদানের মাধ্যমে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে, যা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা উদ্বোধন করেছেন।

ঢাকার যানজট দেশের অর্থনীতির বড় অন্তরায়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে উত্তরবঙ্গগামী ট্রাক ও ট্রেইলার রাজধানীর ভেতর দিয়েই যাতায়াত করে, ফলে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি। আবার রাত ১০টার আগে এসব ভারী যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারায় ভ্রমণকাল বেড়ে যায়, ব্যয়ও বাড়ে। বাইপাস পুরোপুরি চালু হলে ট্রাক, ট্রেইলারসহ পণ্যবাহী যানবাহন আর ঢাকায় প্রবেশ করতে হবে না। আগে যেখানে দুই ঘণ্টা সময় লাগতো, সেখানে লাগবে মাত্র আধা ঘণ্টা। এতে রাজধানীর যানজট কমবে, দুর্ঘটনার ঝুঁকিও কমে আসবে।
প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার যানবাহন এই সড়ক ব্যবহার করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যার ৬০ শতাংশ হবে পণ্যবাহী যান। প্রকল্প চালু হলে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। প্রকল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক সেমি-রিজিড পেভমেন্ট প্রযুক্তি, যেখানে কোনো ইট ব্যবহার করা হয়নি। ফলে সড়কটি প্রচলিত ফ্লেক্সিবল সড়কের তুলনায় অনেক বেশি টেকসই হবে এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও কম হবে। এখানে নির্মিত হচ্ছে ৬টি সেতু, ২টি রেলওয়ে ওভারপাস, ৪৬টি পুরোনো কালভার্ট সংস্কার, ৩৯টি নতুন কালভার্ট, ১২টি চ্যানেল ও ৮টি পদচারী ওভারপাস। সড়কের দুই পাশে থাকবে নিরাপত্তা বেষ্টনী, যাতে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে যান চলতে পারে।

ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে শুধু একটি সড়ক নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক মহাকৌশল। পণ্য পরিবহনে সময় ও ব্যয় কমে যাবে, মানুষের যাতায়াত হবে নিরাপদ ও আরামদায়ক। স্থানীয় অর্থনীতি প্রাণ ফিরে পাবে এবং সড়ককেন্দ্রিক নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠবে। রাজধানীর ওপর চাপ কমার পাশাপাশি আঞ্চলিক যোগাযোগও সহজ হবে। বিশেষ করে ঈদ ও উৎসবকেন্দ্রিক যাত্রায় মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এ প্রকল্প ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্ব পেয়েছে। এটি বেল্ট অ্যান্ড রোড ফোরামে বাস্তব সহযোগিতা প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি এটি এশীয় মহাসড়ক নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সড়ক যোগাযোগে যুক্ত করবে।
আলাপকালে ঢাকা-বাইপাস উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ আসলাম আলী বলেন, প্রকল্পের মোট ৪৮ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের মধ্যে ভোগলা থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটারের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে এবং বর্তমানে অবশিষ্ট অংশের নির্মাণ কাজ চলছে। তবে গত ঈদুল ফিতর উপলক্ষে অস্থায়ীভাবে যানবাহন চলাচলের জন্য আমরা ১৮ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দিয়েছিলাম, যাতে মানুষের যাতায়াত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। তিনি বলেন, চার লেনের বাইপাস এক্সপ্রেসওয়েটি চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে রাজধানী ঢাকা এবং দেশের উত্তরাঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগের একটি কৌশলগত করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হবে। প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ আসলাম আলী আরও বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে উন্নয়ন কাজ ১ বছর বিলম্বিত হয়। আমরা পূর্বাচলে প্রবেশ ও এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বের হওয়ার জন্য আধুনিক সুবিধা সংবলিত একটি ইন্টারচেঞ্জ (ইন্টারক্রসিং) নির্মাণ করব।’
জয়দেবপুর-দেবগ্রাম-ভুলতা-মদনপুর বাইপাস কেবল একটি রাস্তা নয়, বরং এটি জনগণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন। এ সড়ক রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসন, পণ্য পরিবহন সহজীকরণ এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। এ প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসে এটি হয়ে উঠবে এক অনন্য মাইলফলক।